১৪ বিলিয়নে ৯৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ!
দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সমাধান।
আমাদের মহাবিশ্বের বয়স ১৪ বিলিয়ন বছর। কিন্তু পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের ব্যাস ৯৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। আমরা জানি, কোনো কিছুই আলোর গতির থেকে বেশি গতিতে যেতে পারে না। তাহলে সে হিসেব অনুসারে পর্যবেক্ষণযোগ্যমহাবিশ্বের ব্যাস ১৪ বিলিয়ন আলোকবর্ষ হওয়ার কথা।
কিন্তু বাস্তবতা ৯৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ! তাহলে মহাবিশ্ব কি আলোর গতির থেকে বেশি গতিতে এগিয়েছিলো? কিন্তু তা কী করে সম্ভব?
এটা বোঝার আগে আমরা দুটো বিষয়ের ওপর পরিষ্কার ধারণা নিয়ে নেবো।
- ডপলার শিফট
- ডপলার এফেক্ট
আমরা অনেকেই জানি তবুও একটা টাচ দিচ্ছি। আপনি স্থির দাঁড়িয়ে আছেন, দূর থেকে একটি মোটরবাইক হর্ন বাজিয়ে আপনার দিকে আসছে। বাইকটি আপনার যত নিকটবর্তী হচ্ছে হর্নের শব্দও তত জোরালো শোনাচ্ছে। বাইকটি আপনাকে অতিক্রম করে গেলো। বাইকটি আপনার কাছ থেকে যত দূরবর্তী হচ্ছে হর্নের শব্দও তত ক্ষীণ শোনাচ্ছে।
ওপরের ঘটনাটি আমরা সবাই প্রত্যক্ষ করেছি। এই ঘটনা থেকে আমরা দুটো সিদ্ধান্তে আসতে পারি-
ওপরের ঘটনাটি আমরা সবাই প্রত্যক্ষ করেছি। এই ঘটনা থেকে আমরা দুটো সিদ্ধান্তে আসতে পারি-
- উৎস (বাইক) থেকে উৎপন্ন শব্দ আপনার যত নিকটবর্তী হতে থাকবে শ্রুত শব্দ তত তীব্র হবে।
- উৎস (বাইক) থেকে উৎপন্ন শব্দ আপনার যত দূরবর্তী হতে থাকবে শ্রুত শব্দ তত ক্ষীণ হবে।
ধন্যবাদ, এটিই ডপলার এফেক্ট। এখন প্রশ্ন হতে পারে কেনো এমনটি হয়। আমরা পুকুরে ঢিল মেরে ঢেউ (তরঙ্গ) সৃষ্টি করেছি। ঢিলটা পুকুরের যেখানে পড়ে ঠিক সেখান থেকেই ঢেউয়ের প্রবাহ পুকুরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। উৎপত্তিস্থল থেকে যত দূরে যেতে থাকে ঢেউটি ততই দূর্বল হতে থাকে এবং এক সময় এটি জলের সাথে মিলিয়ে যায়।
আমরা জানি শব্দও তরঙ্গ রূপে প্রবাহিত হয়।উৎপত্তিস্থল থেকে যত দূরে প্রবাহিত হতে থাকে শব্দের তীব্রতা ততই ক্ষীণ হতে থাকে এবং এক সময় মাধ্যমে (সাধারণত বায়ু মাধ্যমে) বিলীন হয়ে যায় (ঢেউয়ের মতো)।
মজার ব্যাপার হলো আলোর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। আর আলোও তো তরঙ্গ, তাই এর ক্ষেত্রেও ডপলার এফেক্ট দেখা যায়। কিন্তু আলোর ক্ষেত্রে ডপলার এফেক্ট কিরকম?
আমরা জানি লাল আলোর শক্তি সবথেকে কম এবং নীল (আসলে বেগুনী। কিন্তু আমাদের চোখ নীল আলোর প্রতি অধিকতর সংবেদনশীল) আলোর শক্তি সবথেকে বেশি।
উৎস (যে বস্তু থেকে আলো আসছে) থেকে আলো স্থির পর্যবেক্ষকের নিকটবর্তী হতে থাকলে সেটি নীল (ব্লু শিফট) এবং দূরবর্তী হতে থাকলে লাল (রেড শিফট) দেখাবে। আলোর ক্ষেত্রে ডপলার এফেক্টকে ডপলার শিফট বলে। যেমন- অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি মিল্কি ওয়ের নিকটবর্তী হচ্ছে। ফলে এর থেকে আসা আলো ব্লু শিফট প্রদর্শন করে।
১৯২০ সালে সর্বপ্রথম এডুউইন হাবল দুটো জিনিস আবিষ্কার করেন-
- লোকাল গ্রুপের বাইরে অবস্থিত প্রতিটি গ্যালাক্সি আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
- লোকাল গ্রুপ থেকে একটি গ্যালাক্সির দূরত্ব যত বেশি সেটি (নিকটবর্তী গ্যালাক্সিগুলোর সাপেক্ষে) তত দ্রুত বেগে সরে যাচ্ছে।
২ নম্বর ব্যাপারটি যদি আমরা বুঝতে পারি তাহলেই আমাদের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান হবে। তবে একে বোঝার জন্য আমাদের একটি চিত্রসহ ব্যাখ্যার দরকার পড়বে।
মনে করুন আপনি একটি কিশমিশ কেক বানালেন।প্রতিটিকিশমিশের মধ্যবর্তী দূরত্ব ১ সেমি। আপনি এবার কেকটি বেক করার জন্য ওভেনে রাখলেন। ঠিক এক ঘণ্টা পর আপনি কেকটি বের করে আনলেন। কেকটি প্রসারিত হওয়ায় কিশমিশ গুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব এখন ৩ সেমি হয়ে গিয়েছে। এবার আমাদের হিসেব করার পালা।
চিত্রে দেখানো আছে। আমরা একটি কিশমিশ বেছে নিলাম এবং একে নাম দিলাম Local Raisin। লক্ষ্য করে দেখুন যে বেক করার আগে Local Raisin থেকে 1 নং কিশমিশের দূরত্ব ছিলো ১ সেমি। এক ঘণ্টা বেক করার পর এ দূরত্ব গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩ সেমি। অর্থাৎ Local Raisin থেকে 1 নং কিশমিশটি এক ঘণ্টায় ২ সেমি সরে গিয়েছে। সুতরাং, Local Raisin'র সাপেক্ষে 1 নং কিশমিশটির গতি ২ সেমি/ঘণ্টা।
আবার বেক করার আগে Local Raisin থেকে 2 নং কিশমিশের দূরত্ব ছিলো ২ সেমি এবং এক ঘণ্টা বেক করার পর এ দূরত্ব গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৬ সেমি। অর্থাৎ Local Raisin থেকে 2 নং কিশমিশটি এক ঘণ্টায় ৪ সেমি সরে গিয়েছে। সুতরাং, Local Raisin'র সাপেক্ষে 2 নং কিশমিশটির গতি
৪ সেমি/ঘণ্টা।
একইভাবে, বেক করার আগে Local Raisin থেকে 3 নং কিশমিশের দূরত্ব ছিলো ৩ সেমি এবং এক ঘণ্টা বেক করার পর এ দূরত্ব গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৯ সেমি। অর্থাৎ Local Raisin থেকে 3 নং কিশমিশটি এক ঘণ্টায় ৬ সেমি সরে গিয়েছে। সুতরাং, Local Raisin'র সাপেক্ষে 3 নং কিশমিশটির গতি
৬ সেমি/ঘণ্টা।
এই প্রদর্শন থেকে আমরা বুঝতে পারি যে Local Raisin থেকে একটি কিশমিশের দূরত্ব যত বেশি হবে সেটি তত দ্রুত গতিতে সরে যেতে থাকবে। কিন্তু এখানেই একটি ক্যাচ। আচ্ছা কিশমিশগুলো একে অপরের থেকে সরে যাচ্ছে না এদের মধ্যবর্তী স্পেস (কেক) প্রসারিত হচ্ছে?
নিশ্চই এদের মধ্যবর্তী স্পেস প্রসারিত হয়েছে। বেক করার আগে কেকটি ছোটো ছিলো এবং কিশমিশ গুলো পরস্পর সন্নিকটে ছিলো। বেক করার ফলে কেকটি বড় হয়, ফলে কিশমিশ গুলোর মধ্যবর্তী স্থান প্রসারিত হয়ে এগুলোকে দূরে ঠেলে দেয়।
একইভাবে, ১৪ বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাং ঘটার ১০^-৩৬ সেকেন্ড পর সংঘটিত হয় আরেকটি ইভেন্ট- দ্য ইনফ্লেশন (এ নিয়ে পরবর্তী পোস্টে লিখব)। এই ইনফ্লেশনের (কেকের বেক) ফলে স্পেস আলোর বেগের থেকেও বেশি বেগে প্রসারিত হওয়া শুরু করেছিলো। ইনফ্লেশন প্রমাণ করে যে মহাবিশ্বের বয়স ১৪ বিলিয়ন বছর হওয়া সত্বেও পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের ব্যাস কিভাবে ৯৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ হয়।
কিন্তু আলোর গতির থেকে বেশি!
এখানে আইনস্টাইনের Special Relativity তত্ত্ব বুঝতে আমরা ভুল করি। Special Relativity তত্ত্ব অনুযায়ী কোনো বস্তু স্পেস-টাইমের ভেতর দিয়ে আলোর বেগের থেকে বেশি গতিতে যেতে পারে না।
Special Relativity তত্ত্বের মাধ্যমে আইনস্টাইন স্পেস-টাইমের ভেতর দিয়ে বস্তুর গতির লিমিট নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।
কিন্তু স্বয়ং স্পেস-টাইম?
এর ক্ষেত্রে কিন্তু কোনো লিমিট নির্দিষ্ট করা হয়নি।
অর্থাৎ স্পেস-টাইম নিজে আলোর গতির থেকে বেশি গতি প্রাপ্ত হতে পারে।
সুতরাং স্পেস-টাইমের গতি ফিজিক্সের কোনো নীতি ভঙ্গ করছে না। আমরা ভুলবশত বলে থাকি যে অমুক গ্যালাক্সি আমাদের লোকাল গ্রুপ থেকে আলোর গতির থেকে বেশি গতিতে সরে যাচ্ছে। কথাটা অবশ্যই সঠিক নয়। কারণ গ্যালাক্সিরও ভর আছে। তাই এটি অবশ্যই আলোর গতিতে মুভ করতে পারবে না। প্রকৃতপক্ষে কথাটি হবে- আমাদের লোকাল গ্রুপ এবং উক্ত গ্যালাক্সির মধ্যবর্তী স্পেস আলোর গতির থেকে বেশি গতিতে সরে যাচ্ছে (কেকে অবস্থিত কিশমিশ গুলোর মতো)।
- শেষ কথা!
- আমরা আমাদের কিশমিশ কেক প্রদর্শনে দেখতে পেয়েছি যে Local Raisin থেকে একটি কিশমিশের দূরত্ব যত বেশি সেটি তত দ্রুত বেগে সরে যায়। স্পেসের প্রসারণ সব জায়গায় সমান না। লোকাল গ্রুপ থেকে অন্য গ্যালাক্সির দূরত্ব যত বেশি সেটি তত দ্রুত গতিতে সরে যায়। এবং কিছু কিছু গ্যালাক্সি এত দূরে অবস্থিত যে সেসব ক্ষেত্রে গ্যালাক্সিগুলো আলোর গতির থেকে বেশি গতিতে সরে যেতে থাকে।
- যেহেতু গ্যালাক্সিগুলো আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তাই এগুলো রেড শিফট দেখাবে। আর যেসব গ্যালাক্সি আলোর বেগের থেকে বেশি বেগে দূরে সরে যায় সেগুলোর রেড শিফট ক্রমশঃ ক্ষীণ হতে থাকে এবং পৃথিবী পর্যন্ত আসার আগেই বিলীন হয়ে যায়। ফলে ঐ গ্যালাক্সিগুলো আমরা কখনোই আর দেখতে পাবো না।
- সোর্স : facebook.com/aliahmedunofficial