শনিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২১

আলোর গতি ও সময় ভ্রমণ

 এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার হলো সময় ভ্রমণ বা আলোর গতিতে চলা।  আলোর গতি ই তো সবচেয়ে দ্রুততর, তাইনা? তিন লক্ষ কিঃমিঃ পার সেকন্ড। এতো দ্রুতবেগে চলতে পারে এমন কোনো বস্ত এখনো আবিস্কার হয়নি। এতো দ্রুততম চলার মতো কোনো রকেট/স্পেসশিপ/যানবাহন তথ্য ও প্রযুক্তির এত উন্নতশীল যুগে বিজ্ঞান আবিস্কার করতে পারেনি। তবে ভবিষ্যৎকালে এমন কিছু আবিস্কার হবে কি না। তার সম্ভাবনা ফিফটি ফিফটি। হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। কারণ ভরযুক্ত কোনো বস্ত এত দ্রুত চলতে অক্ষম।

 আমরা জানি, মহাবিশ্বে আলোর বেগ সবচেয়ে বেশি। আর কোনো বস্তুতে আলো এসে পরলে আমরা সেই বস্তুটিকে দেখতে পাই। এক্ষেত্রে বলা যায়,সূর্যের আলো এসে যখন কোনো বস্তুতে পড়বে এরপর আমরা বস্তুটিকে দেখতে পাই। এর আগে কখনোই দেখা সম্ভব নয়।

 সূর্য আমাদের থেকে ৮.১৯ মিনিটস দূরে অবস্থান করছে। সূর্যের আলো আমাদের চোখে এসে পড়ে তারপরই আমরা তাকে দেখতে পাই। আমরা সবসময় ৮.১৯ মিনিটস আগের সূর্যকে দেখি। আমরা জানি, শূন্য মাধ্যমে আলোর গতি 300,000 কিঃমিঃ পার সেকেন্ড। সে হিসেবে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব 149,700,000 কোটি কিঃমিঃ বা প্রায় 15 কোটি কিঃমিঃ। মাত্র ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ডে আলোর গতি 15 কোটি কিঃমিঃ।


  তাহলে, এক বছরে আলোর দূরত্ব কতো? 364*24*3600 সেকেন্ড আলো যতটুকু পথ অতিক্রম করবে।

=365*24*3600*3*10^8 মি

=9.460*10^15 মি

  অর্থাৎ ১ আলোকবর্ষ সমান 9.5 ট্রিলিয়ন কিঃমিঃ বা 5.9 ট্রিলিয়ন মাইল। অতএব বুঝতেই পারছেন, এক বছরে আলোর দূরত্ব কিলোমিটারে প্রকাশ করলে কতো হবে।


আমরা সবাই জানি, সূর্যের পর পৃথিবী থেকে একেবারে কাছের যে নক্ষত্র আল্ফা সেন্টাউরি সেটার দূরত্ব হচ্ছে ৪.২৪ আলোকবর্ষ। তাহলে দেখুন, দূরত্বটা কত বেশি। নিকটতম নক্ষত্রের হিসেব করতে ও আমরা হিমশিম খাচ্ছি।আবার আমরা যখন রাতের আকাশের মিটমিট করতে থাকা তারাগুলো দেখি। ওগুলো থেকে আলো আসতে শুধু মিনিট নয় কয়েক হাজার বছরও লেগে যেতে পারে।

   আমরা যে গ্যালাক্সিতে বাস করছি সেটা হচ্ছে মিলকিওয়ে গ্যালাক্সি, বাংলায় যাকে বলি আকাশগঙ্গা ছায়াপথ। এই গ্যালাক্সির ব্যাস ১০০,০০০ আলোকবর্ষ এই গ্যালাক্সিতে রয়েছে সূর্য ও তার আটটি গ্রহ, ২০৫ টি প্রাকৃতিক উপগ্রহ, ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র। 

আমাদের নিকতটম গ্যালাক্সি হচ্ছে এনড্রোমিডা গ্যালাক্সি। যার ব্যস ২২০,০০০ আলোকবর্ষ, যা আমাদের গ্যালাক্সির দ্বিগুণ। আর দূরত্ব ২.৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ। এই গ্যালাক্সিতে ১ ট্রিলিয়ন বা এক লক্ষকোটি নক্ষত্র রয়েছে।

 আবার দৃশ্যমান মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্যালাক্সি হল বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের IC 1101. এখানে নক্ষত্রের সংখ্যা ১০০ ট্রিলিয়ন। পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বে এরকম ২০ ট্রিলিয়ন গ্যালাক্সি আছে। 😮😮😮

 ১৩.৮ বিলিয়ন বছরের এই মহাবিশ্ব আলোর চেয়ে দ্রুতি নিয়ে বিস্তৃত করেছে ৪৬.৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষের সুবিশাল এক ব্যাসার্ধ। অর্থাৎ দৃশ্যমান মহাবিশ্ব ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষের বিশাল এক গোলক।

এই দৃশ্যমান মহাবিশ্বের প্রান্তসীমা ১৩০০ কোটি আলোকবর্ষ নয় বরং ৪৬০০ কোটি আলোকবর্ষ। এটা কিভাবে সম্ভব? আলোর গতির দ্বিগুণ গতিতে সম্প্রসারণ হচ্ছে মহাবিশ্ব। কারণ বিজ্ঞানীরা ১৩০০ কোটি বছর আগের যে সমস্ত গ্যালাক্সি গুলো দেখেছেন, সেগুলো আলোর দ্বিগুণ গতিতে সম্প্রসারণ হয়ে দ্রুতগতিতে দূরে সরে যাচ্ছে। যার ফলে গ্যালাক্সি গুলোর মধ্যকার বিস্তর দূরত্ব বৃদ্ধি পেয়ে মহাবিশ্বের দেয়ালটা ৪৬০০ কোটি আলোকবর্ষের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। দুই পাশ হিসেব করলে মহাবিশ্বের ব্যাস গিয়ে দাড়ায় ৯৩০০ কোটি আলোকবর্ষে। অর্থাৎ দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ব্যস প্রায় ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ।

এ তো গেলো দৃশ্যমান মহাবিশ্বের হিসেব। প্রকৃত মহাবিশ্ব কত বড় হতে পারে তা অনুমানের বাইরে। দৃশ্যমান মহাবিশ্ব প্রকৃত মহাবিশ্বের তুলনায় অতি ক্ষুদ্র। সে হিসেবে তো প্রতিটি বড় বড় গ্যালাক্সি যেখানে বিলিয়ন বিলিয়ন ইয়া বড় বড় তারকা থাকে সে গ্যালাক্সি গুলো একটি ছোট্ট বিন্দুসম মাত্র। এখন প্রশ্ন হলো এত কম সময়ে মহাবিশ্ব এত বিশালাকৃতি পেলো কিভাবে?

ভাবার বিষয়, মাত্র ১৩ বিলিয়ন বছরে ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ ব্যস। এটা কিভাবে সম্ভবপর? বিগ ব্যাং তত্ত্ব থেকে এর সঠিক জবাব আমরা পাইনা। বিগ ব্যাং তত্ত্ব এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেনা। আমরা ইনফ্লেশন থিওরি তে যাবো। ইনফ্লেশন থিওরি এর জবাব দিতে পারবে। কেননা শুরুতে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ গতি বেড়ে গিয়েছিল সূচকীয় হারে। আলোর থেকে দ্বিগুণ গতিতে সম্প্রসারিত হতে থাকে মহাবিশ্ব। গ্যালাক্সি গুলো খুব দ্রুতগতিতে একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সূচকীয় হারে বেড়ে চলে সম্প্রসারণের গতি। কোনো কিছু সূচকীয় হারে বাড়তে থাকলে তার নমুনা ভবিষ্যতে কিরূপ ভয়ংকর হতে পারে তা কল্পনাতীত।

 

এখানে আইনস্টাইনের Special Relativity তত্ত্ব বুঝতে আমরা ভুল করি। Special Relativity তত্ত্ব অনুযায়ী কোনো বস্তু স্পেস-টাইমের ভেতর দিয়ে আলোর বেগের থেকে বেশি গতিতে যেতে পারে না।


Special Relativity তত্ত্বের মাধ্যমে আইনস্টাইন স্পেস-টাইমের ভেতর দিয়ে বস্তুর গতির লিমিট নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।

কিন্তু স্বয়ং স্পেস-টাইম?

এর ক্ষেত্রে কিন্তু কোনো লিমিট নির্দিষ্ট করা হয়নি।

অর্থাৎ স্পেস-টাইম নিজে আলোর গতির থেকে বেশি গতি প্রাপ্ত হতে পারে।


সুতরাং স্পেস-টাইমের গতি ফিজিক্সের কোনো নীতি ভঙ্গ করছে না।

মহাবিস্ফোরণ পরবর্তী সময় থেকে মহাবিশ্ব কতটুকু বেগে সম্প্রসারণ হচ্ছিল? আমরা জানি যে, মহাবিশ্বের বর্তমান বয়স প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর।  আর ব্যস হলো ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। মাত্র ১৩.৮ বিলিয়ন বছরে ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ ব্যাপ্তী বিস্তৃত হয়েছে। তাহলে কি ধরে নেব আলোর চেয়ে খুব দ্রুত বেগে মহাবিশ্ব এক্সপ্যান্ড হচ্ছে? যেখানে আমরা জানি, কোনো কিছুই আলোর চেয়ে দ্রুতগতিতে চলতে পারেনা।


হুম! আলবার্ট আইনস্টাইন সঠিক। মহাবিশ্ব আলোর চেয়ে দ্রুততর সম্প্রসারণ হচ্ছে এটাও সঠিক। স্পেসটাইম বা স্থানকালের মধ্যে দিয়েই একমাত্র সম্ভব হয়েছে আলোর চেয়ে দ্রুতবেগে সম্প্রসারণ হওয়া। 


 দ্রুতবেগে সম্প্রসারণের ফলে মহাবিশ্বের সবকিছু একে অন্য থেকে দূরত্বে চলে যাচ্ছে। গ্যালাক্সি গুলোর মধ্যকার পারস্পরিক দূরত্ব বেড়ে চলেছে। গ্যালাক্সি গুলো একে অন্য থেকে দুরে চলে যাচ্ছে এ কথা ভুল। বরং গ্যালাক্সির মধ্যকার স্পেস দুরে চলে যাচ্ছে।

  একটি কিশমিশ মিশ্রিত কেকের দিকে লক্ষ্য করে দেখুন। কেক গুলো তৈরি করে কিশমিশ গুলো এক সেঃমিঃ পরপর স্থাপন করা হয়েছে। এবার আপনি যখন এটিকে ওভেনে গরম করতে দিবেন, এক ঘণ্টা পর বের করলে দেখবেন কিশমিশ গুলোর দূরত্ব প্রায় তিন সেঃমিঃ হয়ে গেছে। কিভাবে? কিশমিশ গুলো কি তাহলে দুরে সরে গিয়েছে? না, আসলে কিশমিশের মধ্যকার ফাকা জায়গা বা স্পেস দুরে সরে গিয়েছে, মুলতঃ কিশমিশ সরে যায়নি। অর্থাৎ গ্যালাক্সি গুলোর মধ্যকার স্পেস এক্সপ্যান্ড হচ্ছে।

চলবে.....

--- আমার ডায়েরি থেকে