শুক্রবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২২

সাপ পরিচিতি-৪ চন্দ্রবোড়া

 সাপ পরিচিতি-৪ 


সাপের নাম: চন্দ্রবোড়া, উলু বোড়া

ইংরেজি নাম: Russell's Viper

বৈজ্ঞানিক নাম: Daboia russelii


রাসেল ভাইপার ভাইপারিডি পরিবারভুক্ত একটি অন্যতম বিষধর সাপ। এই সাপ সবচেয়ে বিষাক্ত ও এর অসহিষ্ণু ব্যবহার ও লম্বা বহির্গামী বিষদাঁতের জন্য অনেক বেশি লোক দংশিত হন। আক্রমণের ক্ষীপ্র গতি ও তীব্র বিষাক্ত এই সাপ এশিয়ার সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ যাকে কিলিং মেশিন বলা হয়ে থাকে। এটি হিংস্রতায় পৃথিবীর ৫ম তীব্র বিষাক্ত সাপ ও দাঁতের দিক দিয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম।

 এই রাসেল ভাইপার সাপ আমাদের দেশে মহা বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় প্রথম। এখনো পর্যন্ত যার এন্টি ভেনম তৈরী হয়নি অনেক দেশে। তবে ভেনম তৈরীর কাজ চলছে বাংলাদেশ সহ অন্যান্য দেশে। বিষক্রিয়ায় রক্ত জমা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অত্যধিক রক্তক্ষরণে অনেক দীর্ঘ যন্ত্রণার পর মৃত্যু হয়। সাপটির বিষক্রিয়ায় অত্যাধিক রক্তক্ষরণ ঘটে এবং অনেক যন্ত্রণার পর মৃত্য হতে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভয়ে হার্ট অ্যাটাকেই অনেকের মৃত্যু হয়।

 চন্দ্রবােড়া সাপ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, চীন, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, বার্মা ও ইন্দোনেশিয়ায় পাওয়া যায়। চন্দ্রবােড়া বাংলাদেশের দুর্লভ সাপ।  ইন্ডিয়া থেকে বন্যার পানিতে ভেসে এরা আমাদের দেশে আসে। এটি সব বিভাগে সচরাচর এবং ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চলে এ সাপ পাওয়া যায়।


পরিচিতি ---

চন্দ্রবােড়া সাপ চেনার সহজ উপায় হলো মাথার তুলনায় এর দেহ মােটা, লেজ ছােট ও সরু। চন্দ্রবােড়ার মাথা ত্রিকোণাকার, ঘাড়ের চেয়ে চ্যাপ্টা এবং এর গায়ের রঙ হলদে বাদামি। সারা দেহে কালচে রঙের রিঙ থাকে। চলাফেরা খুব ধীর কিন্ত প্রবলভাবে আঘাত করতে পারে। প্রথম দেখাতে অনেকে এটাকে অজগর সাপের সাথে মিলিয়ে ফেলে বিরাট ভূল করে বসে।

  

অজগর আর চন্দ্রবোড়ার মধ্যে বিরাট পার্থক্য। অজগর ধীর গতির ও সম্পূর্ণ নির্বিষ আর চন্দ্রবোড়া খুবই ক্ষীপ্র ও বিষাক্ত।

 একটি প্রাপ্তবয়স্ক চন্দ্রবোড়ার দেহের দৈর্ঘ্য সাধারণত ১ মিটার, দেহের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ১.৮ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর অজগর আরো লম্বা ও মোটা। 


স্বভাব---


চন্দ্রবোড়া সাপ প্রেশারকুকারের সিটির মতো প্রচণ্ড জোরে হিস হিস শব্দ করতে পারে এবং প্রচন্ড আক্রমনাত্মক হয়ে থাকে। রাসেল ভাইপার মানুষ দেখলেই আক্রমণ করতে পছন্দ করে। এই সাপের একফোঁটা টক্সিন দিয়ে শত শত মানুষকে মেরে ফেলা যায়। অন্যান্য সাপ মানুষ দেখলে পালিয়ে যায় কিন্ত এই সাপ মানুষ দেখলে নিজে থেকে ছুটে এসে আক্রমণ করে বসে। কিছু বুঝে উঠার আগেই চোখের পলকে পরপর কয়েকটি বাইট দিতে পারে। মাত্র এক সেকেন্ডে ১৬ -১৭ টি বাইট নিতে পারে রাসেল ভাইপার। চন্দ্রবোড়া সাপ তিন থেকে চার ফিট অবধি প্রচণ্ড ভাবে জাম্প মারতে পারে। তাই এটি রেস্কিউ করতে গেলে প্রচণ্ড রিস্ক নিতে হয় রেস্কিউয়ারদের। 


 বাসস্থান---


চন্দ্রবোড়া নিচু জমির ঘাসযুক্ত উন্মুক্ত পরিবেশে এবং কিছুটা শুষ্ক পরিবেশে বাস করে। এরা নিশাচর, এরা খাদ্য হিসেবে ইঁদুর, ছোট পাখি, টিকটিকি ও ব্যাঙ ভক্ষণ করে। এরা প্রচন্ড আক্রমনাত্মক হয়ে থাকে। নিজে থেকে ছুটে এসে আক্রমণ করে এই বিষধর সাপটি। দাঁত অনেক গভীর ও সূঁচালো। পৃথিবীতে প্রতিবছর যত মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়, তার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এই চন্দ্রবোড়ার কামড়ে মারা যায়।

 এই সাপের বিষদাঁত বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃহৎ। অন্যান্য সাপ শিকারের সময় শিকারকে কামড় দিয়ে সাথে সাথে খেয়ে ফেলে কিন্তু হিংস্র চন্দ্রবোড়া শিকারকে শুধু একা নয়, তার পুরো পরিবারসহ খেতে ভালোবাসে। তাই অন্যান্য সাপ যেমন একটি ইঁদুরকে কামড় দিয়ে সাথে সাথে খেয়ে ফেলে, চন্দ্রবোড়া সে ক্ষেত্রে কামড় দিয়ে ছেড়ে দেয়। প্রচণ্ড বিষের যন্ত্রণায় ইঁদুর যখন তার গর্তের দিকে ছুটে চলে চন্দ্রাবোড়া তার পিছু পিছু গিয়ে সে গর্তে ঢুকে সব ইঁদুরকে খেয়ে ফেলে। বসতবাড়ির আশেপাশে এদের প্রাচুর্যতা বেশি থাকায় খাবারের খোঁজে রাসেলস ভাইপার অনেক সময় লোকালয়ে চলে আসে এবং মানুষকে দেখে আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে কখনও কখনও আক্রমণও করে।


প্রজনন ---


সাপ সাধারণত ডিম পাড়ে এবং ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। তবে চন্দ্রবোড়া সাপ ডিম পাড়ার পরিবর্তে সরাসরি বাচ্চা দেয়। এরা বছরের যে কোনো সময় প্রজনন করে। একটি স্ত্রী সাপ গর্ভধারণ শেষে ২০ থেকে ৪০টি বাচ্চা দেয়। তবে কোনো কোনো চন্দ্রবোড়া সাপের ৭৫টি পর্যন্ত বাচ্চা দেয়ার রেকর্ড আছে।


বিষ---


চন্দ্রবোড়ার বিষ হেমোটক্সিন, যার কারণে কামড় দিলে মানুষের মাংস পচে যায়। লম্বা বহির্গামী বিষদাঁতের জন্য অনেক বেশি লোক দংশিত হন। ক্ষীপ্রতার দিক দিয়ে সাপটি বিশ্বের ৫ নম্বর ভয়ংকর বিষধর সাপ। নিজে থেকে ছুটে এসে আক্রমণ করে এই বিষধর সাপটি। দাঁত অনেক গভীর ও সূঁচালো। মাত্র ১ সেকেন্ডের ১৬ ভাগের ১ ভাগ সময়ে কাউকে কামড়ে বিষ ঢালতে পারে সাপটি। কামড়ের ক্ষিপ্রগতির দিক দিয়ে সব সাপকে হারিয়ে রাসেল ভাইপার প্রথম স্থান দখল করেছে। তাছাড়া এ সাপটির বিষ দাঁত বিশ্বে দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ। এই প্রজাতির সাপের কামড়ের কিছুক্ষণ পরই দংশিত স্থানে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। ব্যথার পাশাপাশি দংশিত স্থান দ্রুত ফুলে যায় এবং ঘণ্টা খানেকের মধ্যে দংশিত স্থানের কাছে শরীরের আরো কয়েকটি অংশ আলাদাভাবে ফুলে যায়।


এই সাপের কামড়ে শরীরের দংশিত অংশে বিষ ছড়িয়ে অঙ্গহানি, ক্রমাগত রক্তপাত, রক্ত জমাট বাঁধা, স্নায়ু বৈকল্য, চোখ ভারী হয়ে যাওয়া, পক্ষাঘাত, কিডনির ক্ষতিসহ বিভিন্ন রকম শারীরিক উপসর্গ দেখা যেতে পারে। এই সাপের বিষে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হয়। 

রাসেল ভাইপার যে মানুষকে কামড়ায় তাকে বাঁচানো খুবই কষ্টকর। অনেক সময় বিষ নিস্ক্রিয় করা গেলেও দংশিত স্থানে পচন ধরে। তারপর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রোগী মারা যান। পচা অংশ কেটে ফেলার পরেও জীবন বাঁচানো যায় না। দ্রুত পচন ধরে সারা শরীরে। সঠিক সময়ে সঠিকভাবে চিকিৎসা না হলে মৃত্যু অনিবার্য।

সুতরাং, সবার কাছে রিকোয়েস্ট একটাই। কাউকে বিষাক্ত সাপে কামড়ালে কোনো কবিরাজ বা ওঝার কাছে না গিয়ে সরাসরি সরকারি হসপিটালে যাবেন। আর অধিকাংশ সাপ কিন্ত বিষধর নয় তাই সাপের কামড় মানেই মৃত্যু নয়। অনেকেই নির্বিষ সাপকে বিষাক্ত মনে করে হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়।

https://facebook.com/rumman.naik


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন