পড়ন্ত বস্তু, গ্যালিলিও ও একটি প্যারাডক্স
পড়ন্ত বস্তুর ব্যাপারে আজব একটা ধারণা পোষণ করতেন অ্যারিস্টোটল। ভাবতেন, মহাবিশ্বের কেন্দ্র হলো পৃথিবী। মহাবিশ্বের তাবৎ জিনিস তাই সেই কেন্দ্রের দিকে আসতে চায়।
তাহলে ধোঁয়া আর আগুন কেন ওপরে ওঠে? এর যুত্সই ব্যাখ্যা ছিল না অ্যারিস্টোটলের কাছে। জোড়াতালি দিয়ে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাবার চেষ্টা করেন। বলেন, যেসব বস্তুর স্বর্গীয় গুণ আছে, সেগুলো ওপরে উঠে যায়। আর যে সব বস্তু স্বর্গীয় নয়, স্বর্গে যাদের স্থান নেই, তাদের যতই ওপরে ওঠানো হোক, ঠিক পৃথিবীতে ফিরে আসবে।
অ্যারিস্টোটলের যুগে আরেকটা বড়সড় ভুল ধারণা চালু ছিল। দুটি পড়ন্ত বস্তু যদি সমান ওজনের (ভরের) না হয়, তাহলে ওপর থেকে একই গতিতে পৃথিবীতে পড়বে না। ভারি বস্তুটির পড়ার গতি বেশি হবে, হালকা বস্তুটির কম।
আবার যদি হালকা বস্তুর ওজন বাড়ানো হয়, তাহলে তার পতনের গতিও নিশ্চয়ই বাড়বে অ্যারিস্টোটলের মত অনুসারে। এখন ১ কেজি আর ১০ কেজি ওজনের পাথরদুটো যদি দড়ি দিয়ে বেঁধে ওপর থেকে ফেলা হয়, তাহলে কী হবে? এখানেই ঝামেলাটা বাঁধে। তৈরি হয় প্যারাডক্স। ভারী বস্তুটা চাইবে দ্রুত তার নিজের বেগে পড়তে। অন্যদিকে হালকা বস্তুও পড়তে চাইবে তার নিজের বেগে।
তার মানে সে ভারি বস্তুটার পড়ার বেগে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। পারস্পারিক দ্বন্দ্ব বল কাজ করবে তাদের মধ্যে। ভারি বস্তু তার নিজের গতিতে পড়তে পারবে না হালকা বস্তুর বাধার কারণে। অন্যদিকে হালকা বস্তু আগের মতো কম বেগে পড়তে পারবে না, কারণ ভারী বস্তু তাকে দ্রুত নিচে নামাতে চাইবে। সুতরাং বস্তু দুটি তাদের নিজস্ব বেগের লব্ধিবেগে একসাথে পড়তে চাইবে। সেই লব্ধিবেগটা হবে ছোট পাথরটার বেগের চেয়ে বেশি কিন্তু ভারী পাথরটার চেয়ে কম।
পড়ন্ত বস্তু সম্পর্কে অ্যারিস্টোটলের মত ঠিক হলে এমনটাই ঘটার কথা। কিন্তু এখানেও তো আরেক সমস্যা হাজির, যেটা গ্যালিলিও লক্ষ্য করেছিলেন। দুটো পাথরকে দড়িতে বেঁধে দিলে তাদের মিলিত ওজন যেকোনো একটির ওজনের চেয়ে বেশি। ১ কেজি আর ১০ কেজি পাথরকে দড়ি দিয়ে বাঁধলে তাদের মিলিত ওজন দাঁড়াবে ১১ কেজি। যেটা ১০ কেজির চেয়ে বেশি আবার ১ কেজির চেয়েও বেশি। সুতরাং তাদের মিলিত বেগও ভারী পাথরটার চেয়ে বেশি হওয়া উচিত। কিন্তু সেটা আবার অ্যারিস্টোটলের থিওরির সাথে মেলে না। কারণ আগে দেখেছি লব্ধি বেগে পড়বে পাথর দুটো। আর লব্ধিবেগ আবার ভারী পাথরটার নিজস্ব বেগের চেয়ে কম। ফলে তৈরি হয় স্ববিরোধিতা।
এই স্ববিরোধ বা প্যারাডক্সের সমাধান খুঁজতে চাইলেন গ্যালিলিও। সমাধানও পেয়ে গেলেন। বুঝলেন, এই সমস্যার সমাধান তখনই সম্ভব, যদি বস্তু দুটি একই সাথে একই বেগে মাটিতে পড়তে থাকে।
গ্যালিলিও বললেই তো আর সবাই মানবেন না। এতোদিন আঁকড়ে ধরা অ্যারিস্টোটটলের মতবাদকে যে তাহলে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করতে হয়। গ্যালিলিও শুধু মুখের কথায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি যেকোনো বৈজ্ঞানিক মতবাদকে পরীক্ষা করে যাচাই করে দেখতে চাইতেন। এজন্যই তাঁকে বলা হয় পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের জনক।
কীভাবে পরীক্ষা করেছিলেন গ্যালিলিও? এ নিয়ে মজার একটা গল্প চালু আছে। গ্যালিলিওর বাস ছিল ইতালির পিসা নগরীতে। পিসার হেলানো মিনারের খ্যাতি গোটা দুনিয়া জুড়ে। আজও সে খ্যাতিতে ভাটা পড়েনি। অনেকে মনে করেন, গ্যালিলিও পিসার সেই মিনারের ওপর উঠেছিলেন। তারপর সেখান থেকে দুটি আলাদা ভরের বস্তু ছেড়ে দেন। এবং প্রমাণ করেন, পড়ন্তু বস্তুর বেগের সাথে তার ভরের কোনো সম্পর্ক নেই। অনেক বছর পরে নিউটন গিনি আর সোনার পালক পরীক্ষার মাধ্যমে গ্যালিলিওর এই ধারণার প্রমাণ করেন।
লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: মহাকর্ষের কথা/সুকন্যা সিংহ
অভিকর্ষ/জর্জ গ্যামো, অনুবাদ: মো. তোফাজজ্জল হোসেন সরকার
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন